অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারকারী ৫ হাজার এজেন্টের সন্ধান পেয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। গত এক বছরে হুন্ডির মাধ্যমে তারা দেশ থেকে বিদেশে পাচার করেছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এই চক্র গত চার মাসে পাচার করেছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এই পাচারকারী চক্রের ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। জিজ্ঞাসাবাদে সিআইডি জানতে পেরেছে কেবলমাত্র গ্রেপ্তার হওয়া ১৬ জনই ৪ মাসে পাচার করেছে ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
এমএফএস সেবা বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় ব্যবহার করে হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল অর্থ পাচারকারী চক্র। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনা দিন দিনই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি। অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের একটি আলোচিত ইস্যু রিজার্ভ সংকট। রিজার্ভ সংকটের সঙ্গে যুক্ত ডলারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি। এই প্রেক্ষাপটে তদন্ত করে সিআইডি। সিআইডির তদন্তে দেখা যায়, রিজার্ভ সংকটের জন্য রপ্তানি থেকে আমদানি বেশি হওয়ার পাশাপাশি আলোচিত হচ্ছে দেশ থেকে টাকা পাচার ও বিদেশ থেকে অবৈধ পথে দেশে টাকা পাঠানোর বিষয়টি। আর এই কর্মকান্ডের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে হুন্ডির নাম।
অভিযোগে বলা হচ্ছে, দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে রেমিটেন্স ঢুকছে মূলত হুন্ডির মাধ্যমে। এর ফলে সরকার একদিকে বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে। পাশাপাশি প্রবাসীরা তাদের আয় দেশে পাঠালেও হুন্ডির কারণে তা যোগ হচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে। সরকারের কোনো পদক্ষেপেই থামছে না হুন্ডির দৌরাত্ম্য। বরং প্রযুক্তির সহায়তা এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ফাঁকফোকরে দিন দিন আরও ফুলে ফেঁপে উঠছে হুন্ডির কারবার।
সিআইডির অনুসন্ধানে জানা যায়, সংঘবদ্ধ হুন্ডিচক্র প্রবাসে বাংলাদেশীদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তা দেশে না পাঠিয়ে এর সমপরিমাণ অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করে। অপরাধীরা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজটি করে থাকে। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে এবং দেশ থেকে যারা টাকা পাচার করতে চায় তাদের দেয়।
দ্বিতীয় গ্রুপে আছে অর্থ পাচারকারী ও তাদের সহযোগীরা। তারা দেশীয় মুদ্রায় উক্ত অর্থ এমএফএস এজেন্টদের প্রদান করে। তৃতীয় গ্রুপ তথা এমএফএস এজেন্টরা বিদেশে অবস্থানকারীর নিকট হতে প্রাপ্ত এমএফএস নম্বরে দেশীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করে। এসব চক্র প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে এমএফএস ব্যবহার করে ক্যাশ ইনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হুন্ডি করছে। এমএফএস এজেন্টদের সহযোগিতায় পাচারকারীরা বিদেশে স্থায়ী সম্পদ অর্জনসহ অনলাইন জুয়া, মাদক কেনাবেচা, স্বর্ণ চোরাচালান, ইয়াবা পাচারসহ প্রচুর অবৈধ ব্যবসাও পরিচালনা করছে।
সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া গণমাধ্যমে বলেছেন, যে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, গত চার মাসে ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা পাচার হয়েছে। এছাড়া এমএফসের মাধ্যমে হুন্ডি করে এমন পাঁচ হাজারের বেশি এজেন্টের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, তারা এমএফএস সেবা বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় ব্যবহার করে হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।
ওই পাঁচ হাজার এজেন্ট গেল চার মাসে ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং গত এক বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। গ্রেপ্তার হওয়া ১৬ জনের মধ্যে ছয়জন বিকাশ এজেন্ট, তিনজন বিকাশের ডিস্ট্রিবিউটর সেলস অফিসার, তিনজন বিকাশের ডিএসএস, দুজন হুন্ডি এজেন্ট, একজন হুন্ডি এজেন্টের সহযোগী এবং একজন হুন্ডি পরিচালনাকারী।
সিআইডি যে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে তারা হচ্ছে আক্তার হোসেন (হুন্ডি এজেন্ট), দিদারুল আলম সুমন (হুন্ডি এজেন্ট), খোরশেদ আলম ইমন (হুন্ডি এজেন্টের সহযোগী), রুমন কান্তি দাস জয় (বিকাশ এজেন্ট), রাশেদ মাঞ্জুর ফিরোজ (বিকাশ এজেন্ট), মো. হোসাইনুল কবির (বিকাশ ডিএসএস), নবীন উল্লাহ (বিকাশ ডিএসএস), মো. জুনাইদুল হক (বিকাশ ডিএসএস), আদিবুর রহমান (বিকাশ ডিএসও), আসিফ নেওয়াজ (বিকাশ ডিএসও), ফরহাদ হোসাইন (বিকাশ ডিএসও), আবদুল বাছির (বিকাশ এজেন্ট), মাহাবুবুর রহমান সেলিম (বিকাশ এজেন্ট), আবদুল আউয়াল সোহাগ (বিকাশ এজেন্ট) ও ফজলে রাব্বি (বিকাশ এজেন্ট)।
তাদের কাছ থেকে ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৬৮০ টাকা, চার সিমে তিন কোটি ৪৬ লাখ ৪৭ হাজার ২২৯ ইলেকট্রনিক মানি এবং ৩৪টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় মোট চারটি মামলা করেছে সিআইডি।
তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ কর্মকা- মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ২(শ) (১৪) ধারা অনুযায়ী অপরাধ, যা একই আইনের ৪ (২) এর ধারায় দ-নীয় অপরাধের অভিযোগে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলার জন্য অত্যন্ত তৎপর সরকার। হুন্ডি সবসময় রিজার্ভের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের অর্থনীতির এ ঝুঁকি মোকাবিলায় হুন্ডি কার্যক্রমের বিষয়ে নজরদারি শুরু করে সিআইডি।
একটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার এবং দেশের বাইরে অবস্থানরতদের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে না এনে স্থানীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং অপরাধ করে আসছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বা জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকার মতো।
সিআইডির তদন্তে হুন্ডি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠার নেপথ্যে অনেকগুলো কারণ পাওয়া গেছে। হুন্ডি বিস্তার লাভের অন্তরালের কারণগুলো দূর করা গেলে বৈধ চ্যানেলে অর্থ আসার জন্য সহায়ক হবে। সরকারের জন্য রাজস্ব আয় হবে বিরাট অংকের টাকার। যেসব কারণে হুন্ডির বিস্তার লাভ করছে তার মধ্যে বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
অবৈধ অর্থ লেনদেনে বর্তমান সময়ে হুন্ডির বিস্তার ॥ বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে টাকা পাঠানো ও দেশ থেকে অর্থ পাচার এই দুটো বিষয়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয় হুন্ডির মাধ্যমে। প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশ থেকে ডলার আনলে বা ডলার এনে ঘোষণা দিলে সেটা বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে যোগ হয়। কিন্তু অনুমোদিত চ্যানেলের বাইরে দেশে অর্থ আসলে সেটা রিজার্ভে জমা হয় না।
আবার অবৈধ আয়, চাঁদাবাজি-তদবিরে আয় করা অর্থ, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সাধারণত দেশ থেকে পাচার হয়। এছাড়া রপ্তানি মূল্য কম দেখিয়ে এবং আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয় হুন্ডির মাধ্যমে।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের জন্য দেশী বাণিজ্যিক ব্যাংক, দেশের মানি এক্সচেঞ্জ, বিদেশী ব্যাংক ও হুন্ডির রেট ভিন্ন ভিন্ন। ব্যাংকের বিনিময় হারের তুলনায় হুন্ডিতে ভালো বিনিময় মূল্য পান বলেই প্রবাসীরা হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর দিকে আগ্রহী হন। এমনকি সরকার ঘোষিত প্রণোদনার পরও হুন্ডিতে অনেক বেশি বিনিময় মূল্য পান প্রবাসীরা। এজন্যই ব্যাংকের বদলে হুন্ডির দিকে ঝুঁকছেন তারা।
সরকার কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়ে রপ্তানি আয় দেশে ফেরা মাত্রই অগ্রিম আয়কর বা এআইটি কেটে রাখে। ফলে রপ্তানি আয়ের একটা অংশ বিদেশে রাখতে কিংবা পরবর্তী আমদানির জন্য ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা না ভাঙানোর ঝোঁক দেখান ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ আছে, এআইটি থেকে বাঁচতে ব্যবসায়ীরা বিদেশী ক্রেতাদের যোগসাজশে রপ্তানির এলসি মূল্যমান কম দেখিয়ে বাকি টাকাটা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আনেন।
Leave a Reply